সিলেট বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্মম নির্যাতনে নিহত রায়হান হত্যার প্রতিবাদে তিন দিনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির শেষ দিনে বিশাল মানববন্ধন পালন করেছে এলাকাবাসী ও পরিবার। শনিবার বিকাল ৩টায় নগরীর মদিনামার্কেট পয়েন্টে অনুষ্ঠিত বিশাল এ মানববন্ধন একসময় প্রতিবাদ সমাবেশে রূপ নেয়। দীর্ঘ দুইঘন্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় এই মানববন্ধন।
৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার মখলিছুর রহমান কামরানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামীলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পিপি এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। বক্তব্য রাখেন, ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলার রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলার ইলিয়াছুর রহমান ইলিয়াছ, স্থানীয় মুরুব্বি শওকত আহমদ, রায়হানের সৎ বাবা হাবিবুল্লাহ, রায়হানের মামা তারেক আহমদ বিলাস সহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্নগ।
বিশাল মানববন্ধনে শুধু মদিনা মার্কেট এলাকাবাসীই নয়, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় পালিয়ে যাওয়া এসআই আকবরসহ রায়হান হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানান উপস্থিত হাজারো মানুষ। রায়হান হত্যার ঘটনায় মানুষ এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী হয়ে ওঠলেও নতুন কোন কর্মসূচি ঘোষণা ছাড়াই শেষ হয় এ মানববন্ধন ও সমাবেশ।
জানা যায়, গত বুধবার দুপুরে শেষ হয় রায়হান নিহতের ঘটনায় দেওয়া ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম। এরপর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দিলেও কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসে এলাকাবাসী ও রায়হানের পরিবার। বুধবার ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল- বৃহস্পতিবার পিবিআই এর কর্মকর্তাদের সাথে এলাকাবাসী ও রায়হানের পরিবারের সাক্ষাত, শুক্রবার বাদ জুমআ মসজিদে মসজিদে রায়হানের জন্য মোনাজাত ও আজ শনিবার ছিল মানববন্ধন।
এদিকে শনিবারের মানববন্ধন কর্মসূচির পর প্রতিবাদী মানুষজন নতুন কর্মসূচির প্রত্যাশায় থাকলেও আসেনি কোনো ঘোষণা। এ নিয়ে জনমনে কিছুটা হতাশা থাকলেও নতুন পুলিশ কমিশনারের সাথে দেখা করার পর নতুন কর্মসূচি আসবে বলে জানায় আন্দোলনরত এলাকাবাসী ও পরিবার।
এ ব্যপারে আন্দলনরত এলাকাবাসীর পক্ষে আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘আগামীকাল এসএমপির নতুন কমিশনার দায়িত্ব গ্রহণের কথা রয়েছে। এলাকাবাসী ও পরিবারের পক্ষে থেকে এসএমপি’র নতুন পুলিশ কমিশনারের সাথে দেখা করা হবে। তারপর করণীয় তা নির্ধারণ করে কর্মসূচি দেওয়া হবে। সিলেটের সচেতন মানুষ বেঁচে থাকতে রায়হানের রক্ত বৃথা যেতে দেবে না। রায়হানকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে মৃত্যুর মুখে যারা ঠেলে দিয়েছেন তাদের রেহাই নেই। তাদের ফাঁসি না দেয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তা ছাড়বো না।’
রায়হানের স্বজন শওকত হোসেন বলেন- এখন পর্যন্ত পিবিআই’র উপর তারা সন্তুষ্ট। তবে পরবর্তীতে রায়হান হত্যার বিচার নিয়ে টালবাহানা হলে সিলেটবাসী কঠোর হতে বাধ্য হবে। এবং সেই দায়ভার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই নিতে হবে।
এদিকে আন্দলনরত এলাকাবাসীর অন্যতম নেতা সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর মখলিসুর রহমান কামরান বলেন- পিবিআই’র কাজের উপর আস্থা রয়েছে। আমরা আশা করছি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সঠিক পথে এগুবে পিবিআই।
আসামি ধরতে দেরির বিষয়ে কামরান বলেন, ‘পিবিআই আমাদের অনুরোধ করেছে একটু ধৈর্য ধরার জন্য। কারণ, মামলায় কোন আসামি দেয়া হয়নি। এখন তদন্ত ও পুরো বিষয়টি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে একটু দেরী হচ্ছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘বিচারহীনতা ও জবাবহীতার কারণেই দেশে গুম, খুন, ধর্ষণ বাড়ছে। ১৩দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত রায়হানের খুনিদের গ্রেপ্তার করা গেল না। ফাঁড়ি ইনচার্জ এখনো পলাতক, তার সন্ধান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানে না। এসব বিষয়ের কারণে জনমনে এই হত্যার বিচার নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমি দাবি জানাই অবিলম্বে পলাতক এইআই আকবর সহ অন্যান্যদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সিলেটের সাধারণ জনগণকে নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’
তিনি আরো বলেন, সিলেট এসএমপি’র সাবেক কমিশনার রায়হান হত্যায় দায় এড়াতে পারেন না। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের প্রথম থেকেই এসএমপি’র নজদারিতে রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু তিনি তা না করে অবহেলা করেছেন। তার গাফলতির করণেই এসআই আকবর পালিয়ে যেতে পেরেছে। এমতাবস্থায় উচিত ছিলো তাঁকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা। কিন্তু তা না করে তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১১ অক্টোবর (রোববার) ভোরে পুলিশের নির্যাতনে যুবক রায়হান উদ্দিন নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলেন তার স্বজনরা। নিহত ওই যুবক সিলেটের আখালিয়ার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। তবে নিহতের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশ ধরে নিয়ে নির্যাতন করে রায়হানকে হত্যা করেছে।
পরিবারের অভিযোগে ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠিত করেছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ। তদন্তে নেমে পুলিশ হেফাজতে রায়হান উদ্দিনের মৃত্যু ও নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতাও পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
এদিকে ঘটনার পর ১৩ অক্টোবর থেকে লাপাত্তা হয়ে যান বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। এরপর থেকে এখনও লাপাত্তা রয়েছেন ঘটনার মূল অভিযুক্ত এ পুলিশ কর্মকর্তা।
এ ঘটনায় রোববার (১১ অক্টোবর) দিবাগত রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজন আসামি করে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পিবিআই।
Leave a Reply