তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলে আসা মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশের নির্বিচারে স্টান গ্রেনেড, টিয়ারগ্যাস ও গুলিবর্ষণে আরও অন্তত ১৮ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর দেশজুড়ে এই বিক্ষোভে একদিনে সর্বাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে রোববার।
বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে মিয়ানমার পুলিশের গুলিতে এই প্রাণহানি দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন, মান্দালয় এবং দাওয়েইয়ে ঘটেছে। এদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা দেশটিতে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। বিক্ষোভ থেকে সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর দিয়েছে বিবিসি।
দেশটির একজন রাজনীতিক এবং একজন চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, দেশজুড়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর টানা দ্বিতীয় দিনের মতো পুলিশের ব্যাপক দমন-পীড়নে অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও কয়েক ডজন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, তাদের কাছে বিশ্বস্ত তথ্য আছে যে— রোববার অন্তত ১৮ জন নিহত এবং ৩০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
রয়টার্স বলেছে, রোববার সকালের দিকে মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনে শিক্ষকদের বিক্ষোভে স্টান গ্রেনেড ছুড়েছে পুলিশ। এই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজন নারী নিহত হয়েছেন। তবে তিনি কীভাবে মারা গেছেন সেবিষয়ে জানতে পায়নি তার মেয়ে এবং সহকর্মীরা।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে অস্থিতিশীল রয়েছে মিয়ানমার। অভ্যুত্থানের পর দেশটির নেত্রী অং সান সু চি ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) নেতাকর্মীদের আটক করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।
গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জালিয়াতির মাধ্যমে এনএলডি জয়ী হয়েছে বলে অভিযোগ করে অভ্যুত্থানের পক্ষে সাফাই জান্তা সরকার। প্রায় ৫০ বছরের সেনাশাসনের পর দেশটিতে গণতন্ত্রের যাত্রার কয়েক বছর যেতে না যেতেই আবারও সামরিক জান্তা ক্ষমতায় ফিরে আসায় লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছেন।
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দেশটির নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। পশ্চিমের কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সেনা জেনারেলদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের প্রথম ক্যাথলিক কার্ডিনাল চার্লস মং বো এক টুইট বার্তায় বলেছেন, মিয়ানমার একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো।
ইয়াঙ্গুনের বিভিন্ন প্রান্তে স্টান গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর গুলিবষর্ণ করেছে পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার একজন চিকিৎসক রয়টার্সকে বলেছেন, বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসার পর হাসপাতালে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয় রাজনীতিক কিয়াও মিন টিকে রয়টার্সকে বলেছেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় দাওয়েই শহরেও গুলিবর্ষণ করেছে পুলিশ। এতে তিনজন নিহত ও আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের নির্বাসিত নাগরিকদের পরিচালিত অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতি বলছে, মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে একজন নিহত হয়েছেন। এই শহরেও বিক্ষোভকারীদের ওপর ব্যাপক চড়াও হয়েছে পুলিশ। তবে স্থানীয় একটি দাতব্য সংস্থা বাগো শহরে দু’জনের প্রাণহানির তথ্য দিয়েছে।
রোববারের বিক্ষোভে হতাহতের বিষয়ে মিয়ানমার পুলিশ এবং সামরিক সরকারের মুখপাত্রের মন্তব্য জানতে টেলিফোন করলেও সাড়া পায়নি রয়টার্স।
স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলের লাশিও এবং দক্ষিণের মায়েক শহরেও চড়াও হয়েছে পুলিশ। মিয়ানমারের জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং বলেছেন, কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভ দমনে সর্বনি¤œ বলপ্রয়োগ করছে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভে পুলিশি সহিংসতায় দেশটিতে তিন বিক্ষোভকারীর প্রাণহানি ঘটে। এ নিয়ে দেশটিতে গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ২১ জনের প্রাণহানি ঘটল। সহিংসতায় পুলিশের এক সদস্যও নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে সেনাবাহিনী। সূত্র: রয়টার্স।
Leave a Reply