বাংলা বাউল গানের কিংবদন্তি শিল্পী শাহ আব্দুল করিমের ১১ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর বাংলা বাউল গানের এই সুর সম্রাট চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৩ বছর বয়সে ইহকাল ত্যাগ করেন।
বাউল আব্দুল করিম ছিলেন একজন গীতিকার,সুরকার, সংগীত শিল্পী এবং সংগীত শিক্ষক।তাঁর রচিত অসংখ্য কালজয়ী গান তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
সবাই তাকে বাউল সম্রাট নামেই সম্ভোধন করেন।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কালনী নদীর তীরে বেড়ে উঠা শাহ আব্দুল করিমের জন্ম ১৯১৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী।
তাঁর পিতার নাম ইব্রাহীম আলী ও মাতার নাম নাইওরজান। দারিদ্র ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। বাউল সম্রাটের প্রেরণা তাঁর স্ত্রী আফতাবুন্নেসা, যাকে তিনি আদর করে ‘সরলা’ নামে ডাকতেন।
আব্দুল করিমের বাউলগানের প্রতি অসীম ভালোবাসা ছিলো ছেলেবেলা থেকেই।
চরম দারিদ্রতা আর অভাব অনটনের সাথে সংগ্রাম করেও বাংলা বাউল গান,লোকগান,ভাটিয়ালী গানকে তিনি হৃদয়ে লালন করে রচনা করে গেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান।
বাউল গান ভাটি অঞ্চলে জনপ্রিয় হলেও শহরের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায় তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে।
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন।
ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তাঁর গান কথা বলে সকল অন্যায়,অবিচার,কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে।
তিনি তাঁর গানের অনুপ্রেরনা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। যদিও দারিদ্র তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তাঁর শ্রম ব্যয় করতে কিন্তু কোন কিছু তাকে গান সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি আধ্যাত্নিক ও বাউল গানের দীক্ষা লাভ করেছেন কামাল উদ্দীন, সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে।
বাউল আব্দুল করিম শরীয়তী, মারফতি, নবুয়ত, বেলায়া সহ সবধরনের বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন।
২০০১ সালের পর থেকে শাহ আব্দুল করিমের রচিত বাউলগান গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছে অসংখ্য তরুণ গায়ক।
বাংলা আধুনিক ব্যাণ্ড গানকে পাশ কাটিয়ে শাহ আব্দুল করিমের গান নতুন প্রজন্মের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় মুলত শিল্পীর মৃত্যুর পরই।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু জনপ্রিয় গান হলো
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম,কেনো পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু,কোন মিস্ত্রী নাও বানাইলো,আগের বাহাদুরি গেলো কই,বন্দে মায়া লাগাইছে,বসন্ত বাতাসে,বন্ধুরে কই পাবো সখি গো,আমি কুল হারা কলঙ্কিনী, রঙের দুনিয়া তরে চাইনা ইত্যাদি।
স্বল্পশিক্ষিত বাউল শাহ আব্দুল করিম এ পর্যন্ত প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।
বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন দরিদ্রতার সাথে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেও তা যথেষ্ট ছিল না। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা তার সম্মানে জীবন্ত কিংবদন্তীঃ বাউল শাহ আবদুল করিম নামে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া তার জনপ্রিয় ১২ টি গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। এই অ্যালবামের বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ তাঁর বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী ২০০৯ সালের প্রথম দিকে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
বাংলা গানে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমকে একুশে পদক প্রদান করে।
আজ এই কিংবদন্তি গুণী শিল্পীর ১১ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
Leave a Reply