লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন্নবী (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন সংস্থা ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে।
লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম শুক্রবার সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবারের ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তির বাড়ি রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ায়। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক। একই ঘটনায় গণপিটুনিতে আহত হন সুলতান জোবায়ের নামের একজন। তাঁর ও শহীদুন্নবীর বাড়ি একই এলাকায়।
লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম শুক্রবার পাটগ্রাম থানায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করেছি। সিআইডিসহ অন্যান্য সংস্থা ঘটনার বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি, কেউ আটকও হয়নি।
পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তদন্ত কমিটি:
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টি এম এ মোমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাকি দুই সদস্য হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম ও পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেগম কামরুন্নাহার। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা আলামত সংগ্রহ করছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। ১ নভেম্বর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে বলে তিনি জানান।
পুলিশ ও এলাকাবাসীর ভাষ্য, পবিত্র কোরআনের অবমাননার অভিযোগে বৃহস্পতিবার আসরের নামাজের পর বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে পাঁচ থেকে ছয়জন ব্যক্তি শহীদুন্নবী ও জোবায়েরকে মারধর করেন। খবর পেয়ে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাফিজুল ইসলাম তাঁদের সেখান থেকে নিয়ে যান। তাঁদের ইউপি কার্যালয়ের একটি কক্ষে রাখা হয়। এরপর কক্ষের দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশের ভাষ্য, ঘটনাটি জানাজানি হলে উত্তেজিত জনতা বুড়িমারী ইউপি চত্বরে জমায়েত হয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দুজনকে মারধর করেন। পুলিশ জোবায়েরকে সরিয়ে নিতে পারলেও শহীদুন্নবীকে উদ্ধার করতে পারেনি। সেখানেই গণপিটুনি দিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় তাঁকে।
বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খাদেম জুবেদ আলী বলেন, পাঁচ থেকে ছয়জন মিলে দুই ব্যক্তিকে মারধর করলে ইউপি সদস্য হাফিজুল তাঁদের নিয়ে যান।
ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তাঁদের নিয়ে এসে ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে তালা দিয়ে রেখে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের খবর দিই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ছিল যে তাঁদের পরিচয়ও নিতে পারিনি। এরই মধ্যে কর্তৃপক্ষের লোকজন এলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। লোকটাকে কেউ বাঁচাতে পারল না!’
এদিকে শহীদুন্নবীকে হত্যার ঘটনায় রংপুর শহরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারের ভাষ্য, মানসিক চিকিৎসার জন্য শহীদুন্নবী ভারতীয় ওষুধ সেবন করতেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি মোটরসাইকেলে করে বুড়িমারী সীমান্ত এলাকায় ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন।
নিহত শহীদুন্নবী রংপুর শহরের শালবন রোকেয়া সরণি এলাকার আবদুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। রংপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯৮৬ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে এবার এইচএসসির পাস করেছেন ও ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
শুক্রবার সকালে শহীদুন্নবীর শালবনের বাসভবনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকাবাসীসহ আত্মীয়স্বজনের ভিড়। শহীদুন্নবীর স্ত্রী জেসমিন আক্তার আহাজারি করছেন। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক সহজ সরল ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। যারা গুজব ছড়িয়ে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।’
স্বজন ও এলাকাবাসী জানান, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে ২০১৬ সালে চাকরি চলে যাওয়ায় শহীদুন্নবীর একমাত্র উপার্জনপথ বন্ধ হয়ে যায়। এতে মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে সব সময় ওষুধ সেবন করতেন।
শহীদুন্নবীর বোন হাছনা আক্তার বলেন, মানসিক যন্ত্রণার কারণে তাঁর ভাই ভারতীয় ওষুধ খেতেন। তাই সীমান্তের বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকায় চেনাজানা মানুষজনের কাছে ওষুধ আনাতে গিয়েছিলেন।
Leave a Reply