কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণের ঘটনায় পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাতকে সতর্ক করে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘দেশকে পুলিশি রাষ্ট্র বানাবেন না।’ এর আগে বিচারিক হাকিমের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনায় এই এসপিকে সশরীরে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছিল। সোমবার হাইকোর্টের তলবে হাজির হয়ে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াতের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ পুলিশ সুপারকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখেছেন।
একইসঙ্গে ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী ও ওই ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট কাউকে হয়রানি না করারও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
কুষ্টিয়ার এসপি এস এম তানভীর আরাফাতকে উদ্দেশ্য করে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘পত্র-পত্রিকায় যা দেখলাম তা যদি কুষ্টিয়ার বাস্তব চরিত্র হয়, তবে তা হবে জাতির জন্য ভয়ঙ্কর। এমন যাতে মানুষের মনে না হয় যে দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দেশকে পুলিশি রাষ্ট্র বানাবেন না। জাতি উৎকণ্ঠিত, এটা নিরসনের দায়িত্ব আপনাদের।’
হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘পুলিশকে কথায় নয়, কাজে পটু হতে হবে। কে কোন মতাদর্শের, কোন দলের, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। সর্বস্তরের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব। পুলিশ কারও জন্য ভীতিকর না হয়ে তাদের কর্মকা-ে মানুষের বন্ধু হতে হবে।’
আদালতে কুষ্টিয়ার এসপির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী ও আহমেদ ইশতিয়াক। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. তাহিরুল ইসলাম, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. লোকমান হোসেন ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হাতেম আলী।
উল্লেখ্য-গত ১৬ জানুয়ারি ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কুষ্টিয়ার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. মহসিন হাসানের অভিযোগ ছিল, ভোটের দিন দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত এবং পুলিশ সদস্যরা তার সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণ করেন এবং দায়িত্ব পালনে বাধা দেন।
সেজন্য পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেছেন বিচার বিভাগীয় এই কর্মকর্তা। সে আবেদনের অনুলিপি আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের আইজি এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়েও পাঠানো হয়।
লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এর মধ্যে ১৬ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের সময় সকাল ১০টায় ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ওই ঘটনা ঘটে।
মহসিন বলেন, ওই কেন্দ্রে ‘কতিপয় ব্যক্তিকে’ ভোট কেন্দ্রের বুথের ভেতর লম্বা বেঞ্চে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে বসে থাকতে দেখেন তিনি। এ বিষয়ে কথা বলতে তখন তিনি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে বুথের বাইরে ডেকে আনেন। তখনই এসপি তানভীর আরাফাতসহ ৪০/৫০ জন ওই ভোটকেন্দ্রে ঢোকেন।
“তিনি প্রবেশ করেই প্রিজাইডিং অফিসারকে উচ্চস্বরে তলব করেন। তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ফোর্স প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সাথে কথা বলতে না দিয়েই তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেন। তখন আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বলি প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে একটি বিষয়ে কথা বলছি। কথা শেষ হলে উনাকে নিয়ে যান।”
“এরপরেও এএসপি মোস্তাফিজুর রহমান ধমক দিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত আমার দিকে অগ্রসর হন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করেন- ‘আপনি কে? কী করেন এখানে?’
“আমি আমার পরিচয় দিলে তিনি আরও ক্ষিপ্ত স্বরে বলেন, ‘আপনি এখানে কী করেন? বেয়াদব, বের হয়ে যান এখান থেকে’। আমি পুলিশ সুপার ও তার ফোর্সদের আক্রমনাত্মক চরম অসৌজন্যমূলক ও মারমুখী আচরণে হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূর হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি।”
লিখিত অভিযোগে বিচারিক হাকিম মহসিন বলেন, “পুলিশ সুপার ও তার সঙ্গী ফোর্সদের আচরণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ২০১০ এর ৬৯,৭০,৭৪,৮০ ও ৮১ বিধির সরাসরি লঙ্ঘন। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রার্থনা করছি।”
Leave a Reply