সদা হাস্যেজ্জ্বোল, সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এম সাইফুর রহমান। একজন সাইফুর তাঁর কর্মজীবন দিয়ে সারা বিশ্বে পরিচিত একখণ্ড বাংলাদেশ হিসেবে। সেই সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ১২বার বাজেট পেশ করেছেন বর্ষীয়ান এ নেতা। তার মন্ত্রিত্বের সময়কালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘ইমারজিং টাইগার’ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ট সিলেটের এই সন্তান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
আজ ৫ই সেপ্টেম্বর এই ক্ষনজন্মা ব্যাক্তির ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে সিলেটের উন্নয়নের রুপকার কালজয়ী জননেতা এম সাইফুর রহমানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন সিলেটবাসীর প্রিয় অভিভাবককে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করেন। আমীন।
শ্রেষ্ঠ সিলেটপ্রেমী সাইফুর রহমান স্মরণে কবির ভাষায় বলি-
“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।”
সত্যিই চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। সাইফুর রহমান ১১বছর আগে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তিনি মুছে যাননি। সিলেটের শত শত উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাঝে সিলেটবাসীর হৃদয়ে সাইফুর বেচে থাকবেন অনন্তকাল। যদিও বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার থেকে সিলেটের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে সাইফুর রহমানের মুছে দিয়েছে। আদর্শিক কারণে তার অবদান ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা স্বীকার করতে চান না। কিন্তু সিলেটের কোটি কোটি জনতার চোখে সাইফুর রহমানই সিলেটের উন্নয়নের রুপকার। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন স্পীকার হুমায়ুন রশীদ সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। কিন্তু আওয়ামীলীগের শাসনামলে কাজ শেষ না হওয়ায় পুনরায় রেলওয়ে স্টেশনের কাজ শুরু করেন সাইফুর রহমান। সেই সময়ে তিনি তার ভিত্তি প্রস্থরের পাশে মরহুম স্পীকার হুমায়ুন রশীদের ভিত্তিপ্রস্থর পুনঃস্থাপন করেন। এই ছিলেন সিলেটবাসীর প্রিয় সাইফুর।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত তিনবারের বিএনপি সরকারের ছিলেন নির্ভরযোগ্য অর্থমন্ত্রী। অথচ ছাত্রজীবনে তিনি কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন চার্টার্ড একাউটেনটেন্ড।
তাঁকে সর্বপ্রথম রাজনীতিতে আনেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা হত্যার পর রাজনীতির এক অস্থির সময়ে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের হাল ধরেন জিয়াউর রহমান। তখন সাইফুর রহমান জিয়ার বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাকে বাণিজ্যমন্ত্রী করেন বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান।
জাতীয় গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন সাইফুর রহমান। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ব্যানারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছিলেন, সেই ফ্রন্টেরও সদস্য ছিলেন তিনি। জাগদল বিলুপ্ত করে ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি’র জন্ম। সে দলেরও প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিলেটের কৃতি সন্তান সাইফুর। কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয় তাকে। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাকে বানিজ্যমন্ত্রী করেন জিয়াউর রহমান।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর এইচএম এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে অনেক রাজনীতিকের সঙ্গে সাইফুরকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ ও হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদীর আদর্শেই অবিচল থাকেন সাবেক এ অর্থমন্ত্রী। তারই প্রতিদান হিসেবে খালেদা জিয়া যতবার ক্ষমতায় গেছেন ততবার তাঁকেই দায়িত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রীর।
প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল বাছিত। ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে লেটার মার্ক পেয়ে মেট্টিক, ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন এবং কারাবরণ করেন।
তিনি ১৯৫৩ সালের উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য লন্ডনে যান এবং ১৯৫৮ সালে চাটার্ড একাউটেন্সি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন।
১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১-৯৬ মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় তিনি দেশে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) চালু করেন।
১৯৭৯ সালে তিনি মৌলভীবাজার সদর আসন থেকে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য মনোনীত হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে সিলেট-৪ (জৈন্তা-গোয়াইনঘাট) ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে, ২০০১ সালে সিলেট-১ ও মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই সময় তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
সাইফুর রহমান ১৯৯৪-৯৫ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস-চেয়ারম্যান, ১৯৮০-৮২ ও ১৯৯১-৯৫ সময়কালে তিনি বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ও ইফাড এর বাংলাদেশ গর্ভনরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি একনেকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
সাইফুর রহমান ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত হিসেবে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান সফর করেন। ১৯৯৫ সালে কলম্বিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এবং একই বছর বসনিয়ায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন সাইফুর রহমান।
পেশাগত জীবনে তিনি কেমিক্যাল, তেল-গ্যাস উত্তোলন, ট্রানপোর্ট, ব্যাংকিং, ইন্সুরেন্স ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সাইফুর রহমান তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। বড় ছেলে এম নাসের রহমান মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি’র আহবায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য।
এম সাইফুর রহমান ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে সিলেট থেকে ঢাকা আসার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় তৎক্ষণাৎ মারা যান। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার আর কোনদিন পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি তার স্মরণে বিভিন্ন গুণীজনদের সাক্ষর সহকারে একটি বই প্রকাশ করে যেখানে নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনুস সহ বাংলাদেশ অবস্থিত সকল দূতাবাসের রাস্ট্রদূতগন স্বাক্ষর করেন এবং তাদের বেদনাসিক্ত মনোভাব ব্যাক্ত করেন। আমরা মহান এ মানুষটির বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনা করি।
লেখক: সাংবাদিক, সংগঠক ও সমাজকর্মী।
Leave a Reply